আব্দুল্লাহ আল নোমান: করোনা পরিস্থিতিতে সামনে আসছে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ভঙ্গুর দশা। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাজুক পরিস্থিতি বেড়িয়ে আসছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। দেশের অন্যান্য চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম নয় মেহেরপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও রয়েছে জনবলের সংকট। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মঘন্টা মেনে অফিস না করা, রোগীদের ঠিকমত ঔষধ সরবরাহ না করা, রোগীদের হয়রানি হওয়া যেন মেহেরপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের নিত্যদিনের বিষয়। এছাড়া হাসপাতালে ঔষধ সরবরাহ ও বিতরণের তথ্য তালিকা থাকলেও সেটা পূরণ করা হয় না।
এছাড়া হাসপাতালে রয়েছে জনবল সংকট। হাসপাতালের জন্য ১০ টি পদের অনুমোদন থাকলেও পূরণকৃত পদ আছে ৬ টি। হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলোর মধ্যে মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক), ১ জন পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা ও ১ জন সহকারী নার্সিং এটেনডেন্ট পদ শূণ্য আছে। মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) পদে অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব পালন করছেন একই প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এফপি) ডাঃ রুমানা হেলালি। এ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকের পদ শূণ্য থাকায় হাসপাতালে হয় না সিজারিয়ান ডেলিভারী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের কর্মকর্তারা কখনো সময়মতো অফিস করে না। তারা নিজ ইচ্ছামতো চলাফেরা করে। তাদের ইচ্ছেমত তারা হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। হাসপাতালে রোগীদের ঠিকমতো বিনামূল্যে ঔষধ দেওয়া হয় না। বিভিন্ন সময় রোগীদের হতে হয় হয়রানির শিকার। এছাড়া হাসপাতালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে।
নয় মাস আগের কথা। মুজিবনগর উপজেলার মহাজনপুর গ্রামের লাবনী নামের এক গর্ভবতী সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হয় মেহেরপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে। পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেও সন্তান নিয়ে বাড়ি ফেরা হয়নি লাবনীর। প্রশবের পরেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে মা ও শিশুকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মা ও ছেলে উভয়েই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত ছেলের নাম রাখা হয় আবু বকর। লাবনীর পরিবারের দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই লাবনী ও তার নবজাতকের মৃত্যু হয়।
লাবনীর স্বামী মোমিনুল ইসলাম বলেন, তার স্ত্রীকে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে পূর্বের চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না দেখেই নরমাল ডেলিভারি হবে বলে জানানো হয়। আল্ট্রাসনো রিপোর্ট দেখে হাসপাতাল থেকে নরমাল ডেলিভারির কথা বলা হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সেখানে রোগীকে কোন এমবিবিএস ডাক্তার দেখে না। ডাক্তারের সহকারী রোগীর অবস্থা দেখে। আমার স্ত্রীকেও ডাক্তারের সহকারী দেখে নরমাল ডেলিভারি হবে বলে জানায়। আমি রাজি হয়ে যায়। নরমাল ডেলিভারি হলে আমি কেন সিজারিয়ান ডেলিভারি করাবো।
তিনি বলেন, কেন যে আমি ওখানে গেলাম? প্রতিষ্ঠানটি সরকারি বলেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু কি বলবো, সেখানে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারও ছিল না। থাকলে হয়তো আমার স্ত্রী-সন্তান জীবিত থাকার সম্ভাবনা ছিল। আমি যা হারিয়ে ফেলেছি তা তো ফেরানো যাবেনা কিন্তু আমি চাই আর কাউকে যেন এমন পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়। কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পরেন মোমিনুল ইসলাম।
এ বিষয়ে মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এফপি) ডাঃ রুমানা হেলালী জানান, লাবনী ও তার নবজাতকের মৃত্যুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোন ধরণের গাফিলতি ছিল না। রোগীর মৃত্যু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হয়েছে। আমদের এখানে রক্ত পাওয়া যায় না। তবুও আমরা রক্ত ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছি। রোগীকে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। সেখানে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
জনবল সংকটের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ডাঃ রুমানা হেলালী জানান, আমাদের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বিভিন্ন ধরণের সমস্যা তৈরী হয়। যেমন আমরা চাই এখানে সিজারিয়ান ডেলিভারি হোক। কিন্তু এনেসথেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় ইচ্ছা থাকার স্বত্বেও সেটা সম্ভব না।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মঘন্টা পালন না করার বিষয়ে তিনি জানান, আমাদের এখানে কর্মরত সকলেই সময় মেনেই দ্বায়িত্ব পালন করে। একজন আবাশিক পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা সার্বক্ষণিক দ্বায়িত্বে থাকেন। এছাড়া আমাদের এখানে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের পরিবার আছে। তারা খাওয়া-গোসল এবং গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক কাজে হয়তো কখনো কখনো অনুপস্থিত থাকেন। তবে এতে রোগীর কোন সমস্যা হয় না। রোগী হয়রানির অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সরকারি ঔষধ সরবরাহের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ঔষধ থাকলে কাউকে ঘুরিয়ে দিই না। সরকারি সরবরাহ অনুযায়ী আমারা ঔষধ দিয়ে থাকি। তবে শহরের বেশ কিছু এলাকার রোগী হাসপাতালেই আসে শুধু ঔষধ নেওয়ার জন্য। তারা সবসময় বিনা কারণে এসেই আমাদের কাছে ঔষধ চাই। এজন্য তাদের ঘুরিয়ে দিলে তারা অভিযোগ করে বেড়াই।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা উপ-পরিচালক বিকাশ কুমার দাস বলেন, জনবল সংকটের বিষয়ে আমরা উপরে জানিয়ে আসছি দীর্ঘদিন থেকে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ না দিলে আমদের কিছু করার থাকে না। এবছরের জুনের দিকেই একজন ডাক্তার যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে হয়তো নিয়োগ পক্রিয়া পিছিয়ে যেতে পারে।